বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। উন্নত বিশ্বে বজ্রপাত একটি সাধারণ বিষয় হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বে বাংলাদেশেই বেশি। বজ্রপাতে প্রতিবছর যতজন মারা যায় তার এক-চতুর্থাংশ মারা যায় বাংলাদেশে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত আট বছরে দেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে এক হাজার ৮৭৮ জন। বন্যা, সাইক্লোনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ও সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি ভূমিকম্পের মতোই প্রাকৃতিক এবং অতি আকস্মিক একটি বিষয়। তাই বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই।
বজ্রপাত আসলে কী বা কিভাবে সৃষ্টি হয়? সাধারণত জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয় এবং এতে প্রচুর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ জমা হয়। এই মেঘের দুটি তল থাকে; একটি তল থাকে নিচের দিকে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের দিকে (‘-’ ঋণাত্মক আয়নযুক্ত) এবং অন্যটি ওপরের দিকে তথা মহাকাশের দিকে (‘+’ ধনাত্মক আয়নযুক্ত)। যখন মেঘের নিচের তলে ঋণাত্মক আয়নের আধিক্য ঘটে তখন এই আয়নগুলো স্বাভাবিকভাবেই কোনো ধনাত্মক আয়নের দিকে ছুটে যেতে চাইবে। এর ফলে মেঘের ঋণাত্মক আয়ন যেমন ভূপৃষ্ঠের ধনাত্মক আয়নের দিকে ছুটে আসে, তেমনি ভূপৃষ্ঠের ধনাত্মক আয়নগুলোও মেঘের ঋণাত্মক আয়নগুলোর দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হয়। আয়নগুলো একে অপরের সংস্পর্শে এলে আলো জ্বলে ওঠে এবং মেঘের ইলেকট্রনগুলো দ্রুত ভূপৃষ্ঠে চলে যায়। ঋণাত্মক আর ধনাত্মক আয়নগুলোর এই সংঘর্ষ বা সংস্পর্শকেই বজ্রপাত বলে।
বজ্রপাতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ভূপৃষ্ঠে বজ্র (বাজ বা চার্জ) পতিত হওয়া। তবে বজ্রপাত যে সব সময় ভূমিতে পতিত হয়, তা কিন্তু নয়। একটি মেঘের ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক চার্জের সঙ্গে অন্য মেঘের ঋণাত্মক কিংবা ধনাত্মক চার্জের অথবা একই মেঘের নিজস্ব ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যেও হতে পারে। বজ্রপাতের সময় বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, যদিও বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী। মেঘে জমে থাকা স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ অতি উচ্চ বিভবশক্তি (১০ মিলিয়ন ভোল্ট পর্যন্ত) উৎপন্ন করে, যা বাতাসের একটি সরু চ্যানেলকে আয়নিত করে বিদ্যুত্প্রবাহের জন্য রাস্তা তৈরি করে দেয়। ইলেকট্রন যাওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত হয় এবং তীব্র আলোকচ্ছটা তৈরি করে। স্বল্প সময়ে বাতাসের তাপমাত্রা ও চাপের ব্যাপক পরিবর্তন চারপাশের বায়ুমণ্ডলকে প্রচণ্ড গতিতে সম্প্রসারিত করে, যার ফলে বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়। শব্দের গতি আলোর গতির চেয়ে কম হওয়ায় আমরা শব্দ কিছুটা পরে শুনতে পাই।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে কিছু করণীয়
১. উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। উঁচু গাছ থেকে কমপক্ষে চার মিটার দূরে অবস্থান করতে হবে। তবে নিকটবর্তী পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নেওয়াই শ্রেয়।
২. ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে চোখ বন্ধ রাখতে হবে। তবে কোনো অবস্থায়ই মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না। কারণ মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৩. খোলা মাঠ, বাড়ির ছাদ বা উঁচু কোনো স্থান থেকে দূরে থাকতে হবে। গবাদি পশুকে খোলা মাঠে রাখা যাবে না।
৪. বজ্রপাতের সময় ঘরের বারান্দা ও জানালার কাছাকাছি থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রেখে ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে। এ সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে; এমনকি ল্যান্ডফোনও স্পর্শ করা যাবে না।
৫. বজ্রপাতের সময় বিদ্যুত্চালিত যন্ত্রের ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের আভাস পেলে প্লাগ খুলে বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্লাগ আগেই খুলে রাখতে হবে।
৬. বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে দ্রুত পার্ক করা উচিত এবং গাড়ির ভেতরের ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. বজ্রপাতের সময় নদী বা জলাশয় থেকে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে এবং জলাশয় বা জলাবদ্ধ স্থান থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কারণ পানি বিদ্যুৎ পরিবাহী। নৌকায় অবস্থান করলে দ্রুত ছইয়ের নিচে অবস্থান নিতে হবে। নৌকায় ছই না থাকলে নিচু হয়ে পাটাতনে অবস্থান নিতে হবে।
৮. বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ।
৯. লোকালয় থেকে দূরে উন্মুক্ত কোনো স্থানে বাড়ি বানানো যাবে না। বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে তাল, নারিকেল, সুপারিগাছ লাগানো উচিত।
১০. বাড়িকে নিরাপদ রাখতে বজ্রনিরোধক যন্ত্র লাগাতে হবে এবং সেই সঙ্গে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১১. বজ্রপাতে আহত কাউকে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতোই চিকিৎসা করাতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নিতে হবে। সেই সঙ্গে আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃত্স্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণেই মূলত এমন অস্বাভাবিক বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বজ্রপাতের বেশির ভাগ শিকারই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক, শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশের আকাশে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বজ্রমেঘ দেখা যায়। তাই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য বনায়ন সৃষ্টির পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি সবচেয়ে জরুরি।